হাসান রোবায়েতের একগুচ্ছ কবিতা

সমস্ত বৃষ্টি


তুমি চলে গেছ—ফাঁকা রাস্তায় পাতা ঝরছে—পুরানা মসজিদের ওজুখানায় 
একটা কল থেকে পড়ে যাচ্ছে পানি তোমার যাওয়ার মতো টিপটিপ করে—
বন্ধ স্কুলে কতকালের  অবিস্তীর্ণ মাঠে পঙ্গু গরুটা দাঁড়িয়ে আছে আশ্বিনের বৃষ্টিপ্রায়—
তোমার মৌন গান এখনো কেজাইয়ের চরে ঘাসের উপর হেঁটে যাওয়া রোগা ঘোড়াটার ছোট বাচ্চার মত মনে হয়— 

চলে যাও, সমস্ত বৃষ্টি পাটখেতের উপর নিঃসঙ্গতায় ঝরিয়ে—


চিরদূরহাওয়া


হয়তো ভাবছো তুমি নাকফুলটার পাশে আলো
হয়তো ভাবছো তুমি শত বছরের ঝড়ি সয়ে
তোমার শাড়ির পাড়ে বিবাহের হাওয়া থমকালো
কোথাও ফুটছে মায়া শাদা শাদা মাশরুম হয়ে—  
তুমি কি রূপের কথা? ব্যথা পাও, একা হও জ্বরে
প্রবল ঢেউয়ের ঘোরে বোনেদের দিকে চেয়ে থাকো
ইয়াতিম খানার শিশু যেভাবে তাকায় শিক ধরে
যেভাবে পেরোয় কেউ এক বাঁশঅলা কোনো সাঁকো— 
তোমার বাকির খাতা টমেটোর চেয়ে বেশি লাল
তোমার ঋণের টাকা মনে হয় নুহের প্লাবন
পাওনাদারেরা এসে গরুটাকে নিয়ে যাবে কাল
মরণের দড়ি নিয়ে বসে থাকো সারাটা জীবন—
গাছের অমতে ফোটা তুমি সেই ফুলটার ঘ্রাণ
তোমার দিকেই চেয়ে বিসমিল্লা সানাই বাজান—

ছলনা


তোমার ছলনা ভাবি ঈদের কাপড়
গৃধিনী ডাকছে উড়ে হাওয়া-বুলবুল 
কামিজ সরালে যেই খাঁখাঁর হাঁপর 
সহসা চমকে ওঠে তিলের কবুল 
কী জানি কি কেয়ামত ত্রেতা ও দ্বাপর
কালো দু বোঁটাও যেন চোখের বকুল 
কথার খোঁচায় বাড়ে বুকের ফাঁপর
ডুকরে ডুকরে ভাঙে নদীর দু কূল 
ছলনা পাওয়ার মতো আয়ুটুকু নিয়ে
নিজের হাঁসির কাছে দাঁড়িয়ে সেদিন  
মুখোশ আগলে রাখি ইনিয়ে-বিনিয়ে
এ মুখ লুকানো ছিল বেজান-বেদিন 
কাকাতুয়া উড়ে গেছে বিরহ চিনিয়ে—
তোমার তিলের কাছে চির মায়াধীন—!


শুক্রবার 

আমি দোকানি— 
বড়জোড় একজন টিউশন মাস্টার (বলা যেতে পারে) 
প্রস্রাবের ব্যস্ততার মতো 
চারদিকে শূন্য দৌড়
কোথাও শান্ত হয়ে ঝিম ধরে আছে প্রভূত বিকাল—  
যে জামা ছিঁড়েছে বহু আগে
বাতাসে উড়ছে তার মলিন সেলাই

পরিচয়


দূরের কাছে টানলে পরে দোষ
শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে খরগোশ
বললে দানা পানীয় দিও তবে
ভেজা শরীর রাত যখন হবে
উদল দুটি কালো পাখির ছানা
ঘুমায় বুকে আঙুর বনে হাওয়া
আলতো করে খুললে ফিতা, ইশ! 
বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ি কিশমিশ
লজ্জারত, তুমি দু চোখ বোজা
ভাঙবো যেন সারা দিনের রোজা
সেহেরি সেই করেছি কোন রাতে 
ননীর মাঝে আদর পরিখাতে 
আজান দিল জুম্মা ঘরে দ্রুত
যেন তোমার কেন্দ্রে বশীভূত
পানিকাউর উড়াল দিল ঝাঁকে
নাভির তিলে ঝড় উঠলো বাঁকে
ঘোড়ার পিঠে তাতার মনে হয়
‘দস্যু তুমি’ বললে পরিচয়—


চিরদূরহাওয়া

তোমার ঋণের টাকা বেড়ে গেছে চক্রবৃদ্ধি হারে
তোমার টিনের চাল খুলে নিতে চায় সুদখোর
যখন কিস্তির টাকা গুনে রাখো প্রতি বুধবারে
দু হাতে সে লোন নিয়ে হেঁটে যাও কাঁটার ওপর,
ডালিম ফুলের রঙে ভিজে যায় মাঠ—কলপাড়ে
ওজু করো, ধুয়ে দাও সমস্ত আকাশ—মাগরিবে,
রূপার বালার মতো নিমঅন্ধকারে মেপে রাখো
চালের হিশাবটুকু—কত নুন! চেখে নাও জিভে,  
বোনেরা ঘুমিয়ে গেছে, খাবার থালিতে বেড়ে ডাকো—
তাদের ঘুমের ঘ্রাণ থই থই করে সারা ঘরে,
ডুমুরগাছের পাখি ডাকতেছে হঠাৎ হঠাৎ
নিম সব বিষণ্নতা চন্দ্রালোক ভাসে তারপরে
আল্লার কুর্সির মতো আকাশে ছড়ায় সেই রাত—
রজনীল অন্ধকারে বুদবুদ করে ওঠে ঋণ  
তোমার গলার দড়ি মহাশূন্যে ঝোলে প্রতিদিন—


মুসলমানের ছেলে


উপপাদ্যের মতো মেঘে 
টিপটিপ ভিজে গেছো, মন
নিমের ফুলের পাশে তুমি
ছোট এক রোদের মতন—
সেই কত সাল ছিল ধুলা
হরিণঘুমানো সেই রোদ
জানালার পর্দাটা টেনে 
ছুঁয়েছিলে দ্বিধার দরদ—
তোমার জাহাজ ভরা ফুল
ডুবে গেছে বহুকাল হলো
যে জীবন ছিল আমাদের
শুধু তার কথাটাই বোলো—



চিরদূরহাওয়া

তোমাকে দেয় নি বাকি পাড়ার দোকানিগুলো কোনো
তোমাকে দেয় নি টাকা বখিল সুদের কারবারী
তোমার মাংস ও মেদ চেয়েছিল মুয়াজ্জিন, শোনো
রটিয়ে দিয়েছে রাতে তুমি হও অজস্র ভাতারি—
তোমার সংসারপথে কতদিন বনের বকুল
ঝরে গেছে গোধূলিতে, তাদের বিষণ্ন ছায়ায়
নামাজ পড়েছ তুমি, দরদীয়া নদীর দু কূল
উছলে উঠেছে চোখে, তবু দিন যায়, চলে যায়
পৃথিবীপাড়ের ঢেউ—তুমি একা, ছোট দুই বোন
শূন্যের শ্রুতির দিকে চেয়ে বেড়ে ওঠে প্রতিদিন
তাদের ভাতের থালে ঢেলে দাও কার্তিক-আগোন
গভীর ঘুমের পাশে বেঁধে রাখো তারার হরিণ—  
ডালিম ফুলের বনে নির্জনতা পেয়েছো বেনামী
পুরুষ মানুষ নয় তারা যেন হতে পারে স্বামী—







চিরদূরহাওয়া


তোমার বয়স থেকে ঝরে পড়ে কমলার ঘ্রাণ
তোমাকে ভেজায় রোদ মাঠের ফসল ধুয়ে দিয়ে
শরীরের ঘ্রাণ যেন, কালো মেয়ে, বাসমতি ধান
হাওয়ারা তোমাকে ডাকে চন্দনের সুগন্ধি মিশিয়ে— 
কখনো নগরে গেলে তোমাকেও দেবে গৃহকাজ
তোমাকে থাকতে হবে জমিখেত থেকে বহুদূর
বিপুল বস্তির ছায়া খুলে দেবে জীবনের ভাঁজ
কখনো বৃষ্টির ছাটে ধুয়ে যাবে বিপন্ন দুপুর,
সেখানে গার্মেন্টস শেষে দেখা যাবে লোকোত্তর নারী
বাঘের ডোরার মতো অন্ধকার ঠেলে দিয়ে যারা
সারারাত হাঁটতেছে তামাম কামিন যুথচারী, 
বাণিজ্যের পিছে সেই উপনিবেশিত কন্যারা—
শহরে ডাকছে শোনো আফিম মেশানো ঘন রোদ
তোমার হৃদয়ে ফোটে কাঁটা আর ফুলের বিরোধ—


বাতাস বেনামে এলে

এখন, দিনপরে—কুশারের খেত পার হয়ে দেখি
ভাঙা এক চিনামাটির সাথে সকল দূরাকাঙ্ক্ষা মিশে গেছে— 
খাতায় শুধু রেলগাড়ি আঁকা
বাঘ উড়ছে বহু পাখিদের সাথে— 
জামরুল ঝরে পড়া রোদে  
তাকে বলো, বাতাস বেনামে এলে
যেন কিছু নয় অথচ অনেক কিছু 
আমরা পেয়েছি সন্দেহে—






লেখক পরিচিতি :


হাসান রোবায়েত 

১৯ আগস্ট, ১৯৮৯ —বগুড়ায় জন্মগ্রহন করেছেন —পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রকাশিত বই —

ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৬]
ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [ভারতীয় সংস্করণ, বৈভাষিক, ২০১৮]
মীনগন্ধের তারা [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৮]
আনোখা নদী [কবিতা; তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৮]
এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে [কবিতা; ঢাকাপ্রকাশ, ২০১৮]
মাধুডাঙাতীরে [কবিতা; ঐতিহ্য, ২০২০]

ই-মেইল : hrobayet2676@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ