জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা
১. সরাইখানা
সরাইখানা হলো একমাত্র নরক যা মানুষের দুঃখ কমায়।
এখানে যত পান, টসটসে আঙুর, পেয়ালাভর্তি শরবত, যত গান—এখানে মদ খেতে খেতে নিজেকে যত চেনা দায়— তত আমি মাতাল হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ি।
ফুরিয়ে যায় তোমার দেওয়া সময়, তবুও আমি ঘুরি।
আমাকে থামায় পুলিশ। তারা বলে— আপনি কেন এতো রাতে পথে পথে ঘুরছেন?
দুঃখ পেয় বলি, তা আমিও জানি না, যদি জানতাম তবে ঘন্টাখানেক আগেই বাড়ী থাকতাম।
২. আমার মুখ দিয়ে কে কথা বলে?
তোমাকে সারাদিন ভেবে রাতে বলি
আমি কোথা থেকে এলাম? কেন এলাম?
জানি না আমি।
মূলত সেখানেই তো পড়ে আছি আমি,
যেখানে আমি ঝরে যেতে চেয়েছি।
সম্ভবত আমার এই মাতলামি চলে গেছে অন্য কোন সরাইয়ের কাছাকাছি
আমি এখন পুরোপুরি শান্ত, স্থির
যেন আমি কোন ভিনদেশী, অপরিচিত
বহুদিন যাবৎ তোমার খাঁচায় অন্য বনের পাখি হয়ে বসে আছি।
মনে পড়ে যায় আমার আটকে পড়ার দিন
কিন্তু কে আমার গলায় বসে গেয়ে যায় গান?
কে আমার কান দিয়ে আমারই আওয়াজ শুনে?
ভাবি কে আমার চোখ দিয়ে দেখে?
মন আসলে কী? আমার মন দিয়ে কে ভাবে? আমার আত্মায় কে বাঁচে?
কে আমার পা দিয়ে এতটুকো ঘরে ঠকঠক করে হাঁটে?
যদি আমি পেতাম পানির বদলে এক চুমুক জবাব
তবে তা পান করার জন্য আমি ভাঙতে পারতাম এই কয়েদীখানা,
যেহেতু এখানে আমি আমাকে নিয়ে আসি নি, তার অনুমতি ছাড়া কোথাও চলে যেতে পারি না।
যে আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে, তাকেই আমাকে ফিরিয়ে নিতে হবে বাড়ী।
আমি জানি না আমি কি বলব, আমি কোন আন্দাজ করি নি,
না করেছি কোন পূর্ব পরিকল্পনা
বরং আমি খুব শান্ত, চুপচাপ থাকি
যেহেতু আমি তোমার কথা ভেবে অন্য কারো কাছে কবিতা বলি,
বলছি।
৩. আত্মা ও তুমি
এখানে আত্মারা ঘুরে, তুমিও নিজেকে নিয়ে নাও
আমাকে আলাদা করে দেবার দিন, আমাকে আরো একা করে দেবার দিন
তুমিও কোন জনসমাগম রাস্তায় কারো কোলাহল হয়ে যাও
তুমি বরং সুখী হও, হও দুঃখের অপমান।
এখানে আত্মারা ঘুরে, তুমিও নিজেকে নিয়ে নাও
বরং তোমার দুচোখ বন্ধ কর—অন্য চোখে দেখার জন্যে
বরং তোমার হাত খোলো— অন্য হাতে ধরার জন্যে
তারপর বসে পড়ো— যেভাবে আমি বসে পড়েছিলাম আমার কফিনে—
যেহেতু তাদের রাষ্ট্রে ব্যর্থ প্রেমিক আর কবির লাশ সৎকার অযোগ্য—
সেহেতু তুমি বসে পড়ো— আর হও গভীর ধ্যানমগ্ন
যেন একটি আয়নাঘর
তোমার চুলে বিলি কাটে এক মেষপালক,
তোমার হাতধরে কোন এক রাখাল,
তোমার বুকে দাঁড়িয়ে কোন এক কাকতাড়ুয়া—
আমাকে ভাবে পাখি, পাখিকে ভাবে নেকড়ে,
নেকড়েকে ভাবে তুমি।
বরং তুমি আরো ধ্যানমগ্ন হও— আরো ভালবাসো—আরো নিজেকে কাঁদাও
তুমি চিৎকার করে কাঁদো, কেঁদে কেঁদে বলো— সে চলে গেছে, হায় ঈশ্বর,
সে আমাকে ফেলে চলে গেছে,
হায় ঈশ্বর, হায় ঈশ্বর! আমি এতো প্রেম কিভাবে সামলাব?
তুমি আরো জোরে জোরে কাঁদো, কেঁদে কেঁদে বলো—
সে চলে গেছে, সে চলে গেছে
এখন আরো দুইডজন বেশি আসবে!
৪. মন ও মানুষ
দেখো জানালার দিকে গলে গলে পড়ছে
চাঁদ থেকে পালিয়ে আসা জোছনা,
দেখো জোনাকিরাও অন্ধকারে করছে আলোর ফন্দি
সব অশ্রু হাতে নাও, আর নিজের কথা ভাবো
কেন তুমি এখনো খোলা দরোজার ঘরে বন্দী?
আমি জানি আমাকে ধরেছে একটা অদ্ভুত অসুখ
যা আমার ভাবনার চারপাশে একটা মাথাখারাপ পাখি হয়ে নিজের দিকে ঘুরে,
তার প্রত্যেকটা ঘূর্ণি আমাকে টানে,
যেভাবে টানলে আমি গাছের দিকে হেলে পড়ি
যেভাবে হেলে পড়ে হাওয়া,
হেলে পড়ে পানি,
বয়ে বয়ে যাবার মতো...
আমি হারিয়ে ফেলেছি দিশা, আমি হারিয়ে ফেলেছি হুঁশ
জানি সব মাতালের পুলিশে ভয়, কিন্তু পুলিশও তো মাতাল হয়
আমি আরো ঘুরি, মাতাল হই, আমার হয় আরো ভীষণ ভয়
আমি হারিয়ে ফেলেছি মন, নাকি মনের মানুষ?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করতে গুগলে লগ ইন করুন