রিচি তৃপঞ্চমের গল্প
ভয়
বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে মাজেদার বাড়ির উঠোনে হাঁটু পানি হয়ে যায়। কখনও কখনও সাপ এসে হিঁস হিঁস করে মাটির বারান্দায় । মাজেদার ছোট মেয়ে টুনটুনি সকালে একটা সাপ দেখেছে উঠোনে । দেখে দৌড়ে এসে বলল―," আম্মা দেখো আইয়্যা উটানো এখটা হাফ। দুরা হাফ মনো অয়। আও আও"।
শুনে মাজেদার বুক ধ্বক করে উঠে। সাপ যদি উঠোনে আসে তাহলে না কি বন্যা হয়। এমনটাই বলতেন তার দাদী। মাজেদা নিজেও খেয়াল করে দেখেছে বর্ষায় সাপ উঠোনে আসলেই পরের দিন বন্যা হয়েছে।
রাত হয়, মাজেদার ঘুম আসে না। তিন ছেলে মেয়েকে পাশে নিয়ে রাত জাগে। একটু শব্দ হলেই মাজেদার গা শিউরে উঠে। মিঠুটা ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে। ছেলের বিড়বিড় শুনেই প্রতিরাতে মাজেদার মনে পড়ে―মসজিদের হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ আনতে হবে। মিঠু সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। খারাপ বাতাসের কারণে বিড়বিড় করে।
বাড়ির পাশেই ডোবা, সেখানে একসাথে অনেকগুলো ব্যাঙ ডেকে উঠলো। ব্যাঙের ডাক শুনেই মাজেদা বুঝে যায় এইবার খুব ঝড় বৃষ্টি হবে , বন্যা হবে। মাজেদার ঘর মেরামত করতে হবে। ঘরের বাঁশ বদলাতে হবে। চাল বদলাতে হবে। এখনো অনেক কাজ বাকি । অনেক টাকা লাগবে।
ব্যাঙগুলো ডেকেই যাচ্ছে। ব্যাঙের ডাকের মধ্যে মাজেদা বিষাদের সুর শুনতে পায়। তার বুক খালি খালি লাগে। মাজেদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তীব্র মনে হল।
আস্তে আস্তে ব্যাঙগুলো ডাক থামিয়ে দেয়। টিনের চালে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
মাজেদা উঠে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে। রান্নাঘরের টিনের চালের অনেক জায়গায় ফুটো। অল্প বৃষ্টিতে রান্নাঘরের মেঝে ভেসে যেতে থাকে।
ফুটো জায়গা দিয়ে ঘরের ভেতর যেখানে যেখানে বৃষ্টির জল পড়ে, সেখানে মাজেদা মগ, বালতি, হাড়ি যা পেল তাই রেখে এলো।
বিজলি চমকালেই মাজেদা বেগমের মাটির বেড়া আর টিনের চালের ঘর আলোকিত হয়ে উঠে। বিজলি যত চমকায়, মাজেদা তত ভয়ে ছোট হতে থাকে। বজ্রপাত হলেই কেঁপে উঠে। হঠাৎ করেই মাজেদার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়।
শ্রাবণ মাসের এগারো তারিখ, আয়জফর মিয়ার সাথে মাজেদার বিয়ে হয়েছিল। সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। আয়জফর বৃষ্টিতে ভিজে জবজবা হয়ে গিয়েছিল। আয়জফর ঠান্ডায় কাঁঁপতে কাঁপতেই বিয়ে করেছিল। এ নিয়ে মাজেদার ভাবীরা খুব হাসাহাসি করেছিল। সেদিন মাজেদার খুব মায়া হয়েছিল আয়জফরের জন্য।
রাতেই আয়জফরের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। সদ্য বিয়ের পিঁড়িতে বসা কিশোরী মাজেদা তখন কি করবে বুঝতে পারে নি।
আয়জফর হেসে হেসে বলেছিল― ,"কিজাত জ্বর দেখছো নি বিয়ার দিনও ছাড়ছে। এ জ্বর যা আইজ বিয়া খরছি বে।"
মাজেদা তখন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেছিল ―,"আসোইন খেনে ?"
আয়জফর উঠে বসে, মাজেদা হাত ধরে হা হা করে হেসে উঠেছিল। আয়জফরের স্পর্শে মাজেদার শরীর বেয়ে নেমে গিয়েছিল শীতলধারা।
পরের দিন মাজেদা ঘুম থেকে উঠে দেখে উঠোনে পানি জমে গেছে। আয়জফর তখনও জ্বরে ভোগে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত আয়জফরের দিকে তাকাতেই তার মনে হল মানুষটা খুব ভালো।
জ্বর থেকে সেরেই আয়জফর মাছ ধরতে চলে গিয়েছিল। বাইন মাছ ধরে নিয়ে এসে বলেছিল ,"মাজেদা দেখো হাফ ধইরা আনছি। খাইবায় নি"
মাজেদা অবাক হয়ে বলেছিল ―,"কিতা খইন !"
আয়জফর বেতের ঝুড়ি থেকে বাইন মাছ বের করে হাসতে হাসতে বলেছিল ―,"ওউ দেখো হাফ।"
মাজেদা লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল ―,"খইলত থইন ! ইতা আমি খাই না । ছিঃ!"
আয়জফর সেদিন জোর করে মাজেদাকে বাইন মাছ রান্না করে জোর করে খাইয়েছিল।
বিয়ের সাতদিনের মাথায় আয়জফর সিলেট কর্মস্থলে ফিরে যায়। মাজেদা বেগমের বুক খালি খালি লাগছিল। আয়জফরকে ছাড়া দিন যেন কেমন কেমন লাগছিল। মাজেদার শাশুড়ি বলেছিলেন ―," তুমি ছিন্তা খইরো না। ঠিক অইযিবো। জফরের ছুটি খম। দুই ঈদ ছাড়া হের ছুটি নাই।"
শুনে মাজেদার বুকের খালি খালি ভাবটা বেড়ে যায়।
প্রথম প্রথম মাজেদার খারাপ লাগতো। কাজ ঠিক মত করতে পারতো না। মন খারাপ হত। আস্তে আস্তে মাজেদা আয়জফরবিহীন সংসারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
দুই ঈদে আয়জফর আসত। একদিন রাতের বেলা আয়জফুর বলেছিল ―,"তোমারে আর আম্মারে সিলেট লইয়্যা যাইমু গি। তুমি আমি মাঝে মাঝে ঘুরানিত যাইমু। সিনেমাহলো সিনেমা দেখাত যাইমু। ফুচকা চটপটি খাইমু।"
মাজেদা শুনে খুব খুশি হয়েছিল। অবাক হয়ে বলেছিল ―,"জসিম শাবানার ছবি দেখার যে শখ আমার সিনেমাহলো বইয়্যা। কিন্তু ফুচকা চটপটি কিতা ?"
শুনে আয়জফর হেসে উঠেছিল৷ সেরাতে খুশিতে মাজেদার ঘুম আসে নি। খুশিতে ভাসছে ঠিক সেই মূহুর্তে জোরে বজ্রপাত হলে মাজেদার খুশিতে বাঁধা পড়ে। মাজেদা ―"ও মাই গো" বলে চিৎকার দেয়। আয়জফর হেসে কুটি কুটি হয়ে বলেছিল― ,"আমার বউ ঠা ঠা ডরায় !"
মাজেদার আর সিলেট যাওয়া হয় না। এর মধ্যে শাশুড়ি মারা গেলেন। মিঠুর জন্ম হল। মিঠুর দুই বছরের মাথায় মিতা হল। তার এক বছরের পর টুনটুনি। বাড়ি জীর্ণ হয় , আয়জফর দুই ঈদে বাড়ি আসে। কিন্তু টুনটুনির বয়স যখন পাঁচ মাস তখন থেকে আর আয়জফর বাড়ি আসে না। সবাই বলাবলি করে আয়জফর নতুন বিয়ে করেছে শহরে। আবার কেউ কেউ বলে আয়জগর মারা গেছে। যেখানে কাজ করতো সেখানে আগুনে পুড়ে আয়জফর মারা গেছে। মাজেদা এসব কিছুই বিশ্বাস করে না। আয়জফর ফিরে আসবে আর হেসে হেসে বলবে ―,"হাফ আনছি। খাইবায় ?" এই বিশ্বাস নিয়ে সাত বছর ধরে আছে।
―"আম্মা ফেসাবে ধরছে।" টুনটুনির কন্ঠস্বরে মাজেদার ভাবনা ভাঙে।
সকালে মাজেদার বাড়ির উঠোনে হাঁটু পানি হয়ে গেছে। মিঠু মাছ ধরতে যায়। মিতা আর টুনটুনি পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। মাজেদা আলু কাটতে কাটতে ওদের বলছে ―,"ফানি থাকি উইঠ্যা আইলে নি তোরা ?"
মিতু আর টুনটুনি মায়ের ধমক কানেই নেয় না। ঝাপাঝাপি করতেই থাকে।
খানিক পরেই মিঠু ফিরে আসে, হাত থেকে মাছের ঝুড়ি মায়ের সামনে রেখে বলল ,"আম্মা ইয়া বড় হাফ আনছি।" বলে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
মিঠুর হাসি দেখে মাজেদার মন উদাস হয়। আয়জফরের হাসির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় আয়জফরের হাতের স্পর্শের কথা। শরীরে শিহরণ খেলে মাজেদার। শরীরে অনেক বছর পরে এমন শিহরণ লাগল মাজেদার। শরীরে এক ধরণের টান অনুভব করে মাজেদা।
সেদিন দক্ষিণ পাড়ার রজব আলী মাজেদাকে বলেছিল―,"রাতে ঘুম আসে মিঠুর মা ?" বলেই খিক খিক করে হেসেছিল।
মাজেদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাজেদার সিনেমা হলে গিয়ে জসিম শাবানার ছবি দেখা হয় নি। ফুচকা চটপটি খাওয়া হয় নি। এটা মাজেদার ব্যক্তিগত দুঃখ।মাজেদা দ্রুত আলু কাটে। আলু কাটতে কাটতে বলল ," মিঠু যা গুছল খইরা আয়। ঐ মিতু আর টুনটুনি আইলে নি ?"
মিতু টুনটুনি পানিতে ঝপাং শব্দ তুলে আর মাজেদার বুকে তার ব্যক্তিগত দুঃখ ঝপাং শব্দ করে। মাজেদার ভয় ভয় লাগে―
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করতে গুগলে লগ ইন করুন