অয়ন্ত ইমরুলের কবিতা
সামান্যই নূপুর ছোট ছোট আলতো বিকেলের
ছায়াটা সরে না।
ছায়াটা নেচে নেচে ফিরে আসে দুপুরের রোদে—
সেই কবে এই দুপুর লুকিয়ে রেখেছিল সুষমা ভাঙা স্যুটকেসে!
তারি সরু খালের সাঁকো পার হয়ে,
আরশি জগত ঘুরে এসে, দূরের ভাঙা মন্দিরে ভিক্ষুসীমায় বসে দেশনা করছে ফালি-ফালি খাঁখাঁ।
এই প্রবারণায় যারা হারিয়ে খুঁজে করণাঘন অনুপুঙ্খ দিন—
গমের ভঙ্গিমায় দুলে ওঠে হাওয়াকে তারা শোনাতে পারে না নিবিড় ঘণ্টাধ্বনি—
এমন প্রবারণায় মুছে যায় আয়ুরেখা,
মুছে যায়,সমস্ত বসন্তে বুকের পালিশ।
তখন মর্মর ভুলে যাওয়া রজনীগন্ধার বনে বারবার হোঁচট খায় বনবিহারি।তাকে বলি:
এত সোজা নয় ফিরিয়ে দেয়া সুলেখা কুমকুম;লেইস ফিতার ফেরিওয়ালা
ঢেঁকিকলে ঘুমিয়ে থাকা একান্ন দুর্দিনে এগিয়ে দেয়া হুইল চেয়ার পাহাড় থেকে পড়ে যায়;
পড়ে যায় কারো আলতার শিশিতে আটকে থাকা মন।
কি এক ঝোলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে কিশোরী আসে!
তার টিফিনবাক্স খোলার ইচ্ছে থেকে গড়িয়ে গেছে হাজার বর্ষাকাল।
কামারের হাঁপ থেকে হাপরে যেতে যেতে
হাওয়ায় কেবল আগলে রাখি তার চলে যাওয়ার ঘ্রাণ
ঘ্রাণ থেকে উবু হয়
অন্ধহুতোম,বেথুলের ঝোপ—সামান্যই নূপুর ছোট ছোট আলতো বিকেলের
অশোকস্তম্ভের নিচে;কারা যেন রেখে যায়,
আমাকে নাচিয়ে যায় জীবন ক্রশয়ার কঠিন শিকলে।
রক্ত চুইয়ে পড়ে।নাগকেশরের গন্ধে যেভাবে ডুবে যায় চাঁদ;
চাঁদের কন্যারা,কৃষ্ণগহ্বরে বার বার ভুল হয় মানষাঙ্ক।
তুমি চলে যাও ফসলের মায়া
তবু তোমাকেই কুড়িয়ে রাখি সুপ্রীতির ঘরে
তোমাকে কুড়িয়ে রাখি মেঠোময় বুলি
পরান কথার বনে দোল খায় ডালিমের শাখা।
তোমাকে কুড়িয়ে রাখি
থোকা থোকা ভালবাসা সোনাবাজু মোড়ে
তোমাকে কুড়িয়ে রাখি
গাছের অনেক দূরে কুটুম পাখিটি
আমাদের গানগুলো ঠোঁটে নিয়ে ওড়ে গেলে যেই চরাচরে—
সেখানে ঘুমিয়ে আছে একা বালিহাঁস
তোমাকে হলো না বলা: পথ ভোলা রাঙাদির পায়ের দুপুর;
শান্ত দ্বিবীজ পাতায় লুকিয়ে থাকা বসন্তে একদিন চুপসে গেলে আনচান রঙিন বেলুন
অথবা ঘুড়ির ভোকাট্টায় থই-থই কৈশোর পেরিয়ে এই দাঁড়িকমাই জীবন।
পায়ের অধিক তাথৈ
১
ঘনিয়ে আসা ঘুঙুরে কারো পা।পায়ের অধিক তাথৈ
নিপুণ ভগ্নাংশের দিকে—
জল্লাদ জাতীয় কেউ একজন
জেব্রাঘড়ির কাঁটায় চোখ রেখে দাগীর চেহারা মাপে।
ঘন্টায় ঘন্টাকর্ণ— সামান্যই কাঁসা,
বহু ব্যাপারি
দেশরাগ ক্ষীণ ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ
দাগী হাসছে খিকখিক
ফাঁসির মঞ্চে অমাবর্ষা,চাঁদ জাগানিয়া গান
বৃথা
জানুয়ারি টেনে শীতের বরফ জমাচ্ছে
এন্টার্কটিকা
সবাই বিমূঢ় ভীষণ আইস-সিম্ফনির বরাতে...
২
ভেজা সন্ধ্যায়, পাঠে পাখির ফেরা
এ বাতাস ঝড়ের মূলধন—
ধীরে ককিয়ে উঠে,শান্ত হয় শান্তিবানুর আঁচলে।
ভেতরে ঝরে যাওয়া আমের আনন্দ
তাকে বলি: অস্থির শৈশব,
ডানপিটে কৈশোর।
তারে সিঁথিহাঁস জেনে কোলে তুলে নাও।
সামান্য আঙুল বুলাও পরম আদুরে।
এই পাড়া গাঁয়ে আমি রয়ে গেছি,
ঢোলকলমি ফুলে রটিয়ে মেঠো বুলি
আমার আত্মায় বার বার জেগে ওঠে তারই পুলক।
অথচ,তুমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দাও
সাতভায়লার গান!
৩
সকাল থেকেই মেঘের মরিয়ম নেমে
জ্যোৎস্না ঢালছে।
মাঠের বাতাবি চুইয়ে রামধনুর ষোল আনা
জলের দিগন্তে।
নদীর নারীয় হাওয়া এত যে কাঁচা বয়েসী—
আমাদের যত পালতোলা ফেরে হাড়ের পিয়ানোয়;
স্রোতের বীত সত্যে মোহনার মেয়েরা
লাফিয়ে ওঠে অবিচ্ছিন্ন—
বালিহাঁস সেলাই করা আঙুলের ছকে
তোমার চাঁদপুর বোবা হয়ে রয় স্তূপের শীষে।
আমার কঙ্কালে ইলিশ বেজে যায় আর রুপাসামান্য ভাষায় স্মৃতির বেড়াল—
রাত যত বাড়ে তার চোখ ততই জ্বলে ওঠে...
৪
কখন হিজল জলে স্নান,ঝিনুক তালাসে
দুপুর,চোখের ভয়ে হেলেঞ্চাসাপ,বারো কিশোরীর কচুরিপানা বুকের অথৈ নিয়ে ফোটে—
বিদিশা জুড়ে চাঁদের পরাগ।
তুমি ফ্রক পেরোলেই পাহাড় পেঁচিয়ে পথ ডাকে শিসপ্রিয়া সারা দুপুর—
ঘুঙুরে বেজে যাই।
কি এক হাওয়া, গাছের দোল হাতের মুদ্রায়,
মুঠো খুললেই হারিয়ে যায় প্রজাপতির তিড়িং ও টুনটুনের বেহাগ!
মখমলি নীরবতায় গাঢ় কোন তৃষ্ণার দিকে হেঁটে আসে বিপন্ন টমটম।
৫
ছায়ার পালিকা সে, ঘৃতকুমারীর গালে
টোলের সন্নটা—
আমার তেপান্তর তোলপাড় করে ভাসায়
ঝুমুর নদীর কলতানে।
ডাবলিউ মুদ্রায় যে ছুঁতারের ভাঙা পরান
আন্ধার হইলে জাইগা ওঠে
তাকে বলি কাঁটাবহরির আড়ালে ডাহুক হও—রাতের চন্দ্রপুলি লুটিয়েছে সেখানে।
সেখানে,পাতার বিছানায় শুইয়ে থাকা চাঁদ
এসেছে আরেক জনমের কথা নিয়ে।
ফল আর ফুলের ঘ্রাণে ধিকিধিকি পৃথিবীর
জুড়াবার যেটুকু ঠাই মাটির সুরভি নিয়ে বইয়ে রাখে,
ওখানে ঝর্ণা হই,কারো পারাপার ভেবে হই সরুখালের সাঁকো।
পাতার আড়ালে ভুলে যাও
পাতায় ফিরে এসে হে মর্মর অবিরাম গান ধরো বাউকুড়ানির।
ঝোড়ো হাওয়ায় ওড়ো তুমি যার মৃত।
জৈগুনের চাঁদ টিলিক দিলে রাঙাদি ফিরে চন্দ্রদ্বীপের কথায়—
এই চন্দ্রবিন্দুর আকালে কতটা খোল বালক আদর্শলিপি?
শৈশবের প্রতিটা দোল সরে গেছে দোলনা থেকে।
যেভাবে লুকিয়ে রাখো কিচিরমিচির
পাতার আড়ালে ভুলে যাও জন্মদাগ তুমি হে বায়স্কোপের মেয়ে।
যতটা ফুরফুরে তুমি তারো অধিক বিষন্ন
ঝর্ণা খুলে রাখো
ঈর্শার অনুযোগে সামান্যই ছন্দ তুলে জলপ্রপাত।
তবু খুঁচিয়ে আইস-সিম্ফনি উড়ে যায় সাদা পাখি।
ঋতু ফিরে,রুক্ষভাষী।যে সব মানষাঙ্ক
কান পাতে রুপালি রোদের পদধ্বনিতে—
ছত্রিশ ব্যঞ্জনে অঞ্জলি পায় আমার কৈশোর—
বলে বুনোগন্ধের ঢেউয়ে এসো
ভেসে ভেসে দেখাবো লীলা লেলানো নৃত্য।
যেনো কোনো দূর থেকে
এখন বিকেল
অতিকায় দেওদার শান্ত হয়ে আছে
এইসব হাওয়ায়—
যেনো কোন দূর থেকে স্পষ্ট আইস-সিম্ফনি দিয়ে যায় হেমন্তের দেহ ভার।
তাকিয়ে থাকার শীষে পরস্পর দোল বিন্যাস জাগিয়ে রাখে ত্রস্তশিসের বুলবুলি।
নড়ে ওঠা মাছরাঙায়;— ধীর বকচক,বকের পাখার পরে যখন উড়েছে
পুকুরের হাঁসগুলো একবার স্মরণ করে রাঙাদির খোয়ার—
ভুলে যায় বাংলাদেশের সন্ধ্যা।
পাথর কথা বল
জননীর চৌকাঠে লেগেছে রক্ত
আজ উল্লাসের নাই কোন বেড়া
পাথর কথা বল দরজার কাছে এসে
বল— এ ধর্ষণস্নাত ভূমি আমার।
পাথর কথা বল,পাথর কথা বল
তোমার মায়ের কাপড় আজ টেনে ছিঁড়েছে ভাদ্রের কুকুরেরা
পাথর কথা বল পাথর কথা বল
বল—শুয়োরের বাচ্চা
কেননা, তোমার অতীত কখনই বোবা ছিল না।
বাংলাদেশ
ঘরকাতুরে লোকগুলো সিঁড়িপথে পড়ে যায়
এমনই রাত—রাতের তলপেটে মুখ গুঁজে দেখি একটা অজগর বনের দিক থেকে আসছে;
তাকে তুমি তুলে দাও মাংসের উন্মমনা ঢেউ,
অথচ নিকটে মান্দার গাছে একেবারেই লিকলিকে পাটখড়ির মতো শিশ্ন ঝুলে থাকে!
আমাদের বারোমাস বসবাস এই মান্দার তলায়
অনেকেই ফিসফিস করে বলে ধর্ষিতা
আমি কান দেই না তাদের কথায়।
প্রথম যখন ধর্ষিত হই ব্রিটিশদের শিশ্নে বেঁধে দিতে চেয়েছিলাম লাল রিবন।
দ্বিতীয় বার যখন ধর্ষিত হই পাকিস্থানীদের শিশ্ন কাটতে পারিনি বিচ্ছিন্ন বঁটিতে।
অথচ যুদ্ধ জয়ের পর থেকেই ধর্ষিত হচ্ছি আমারই স্বজাতি বাঙালি দ্বারা।
আমি ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে পারি না
কেমন কুঁচকে যাই বার বার
সুযোগে ধর্ষক এগিয়ে আসে
ধর্ষক এগিয়ে এসে জানান দেয় এই বাংলাদেশ তাদেরই একার...
থমকে দেখি
দীপ নেভানো পুরনো এক গাছা
কাঁসার থালা ধূলায় মুখ খোলে
থমকে দেখি দেয়ালে পরগাছা
দোলন চাঁপা বাতাস ছাড়া দোলে।
রেলিঙে কেউ দাঁড়ায় চিরকেলে
কাঁধের পর বুলবুলিটা বসে
হুঁকার মিড়ে টিলিক দিলে পরী
পূর্বরাগে শুকতারাটি খসে।
ভাঙা ইটের ঘরেতে কেউ ছিলো
দুয়ার এঁটে দিয়েছে কেউ খিল
মোষের শিঙে চাঁদের ঝোলে থাকা
গয়না পরে তিন— প্রহরে বিল।
এখানে মেঘ বহু যুগের চেনা
এসিডে তার ঝলসে গেছে মুখ
পরাঙ্মুখ হরিণ গিনিঘাসে
মানুষ শুধু আগুনে উৎসুক।
নদীর ধারে শ্মশান পোড়ে একা
জানলা খোলা বাড়ানো মুখ কারো
বিমূঢ় চোখে খেলে এক্কাগাড়ি
ঘুমপাড়ানি গানটা কেউ ধরো।
আগুন সহো সহো শবের মায়া
ভাঙে কারো ভেতরে হাড়গোর
গোরের পাশে মানুষ থাকে একা
মানুষ খোঁজে মানুষে ঘরদোর।
লেখক পরিচিতি :
অয়ন্ত ইমরুল : প্রকাশিত বইসমূহ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করতে গুগলে লগ ইন করুন