তানি তামান্নার কবিতা

পানফুল

দুর্দিন ম্যাগাজিন-Durdin Magazine


নাম মরে গ্যালে জীবন্ত হয়ে উঠে আমার কফিন;

নরকে ভিড় ঠ্যালে এগিয়ে যাই— 

ঘৃণার বীজ পোকাক্রান্ত;


ডানা ভাঙ্গা একটা পাখি— 

আহত পাঁজর পদ্মের তোরণে তুলে রাখি।


আহবান ভুলে গ্যালে হাঁটতে শুরু করে ঘুমন্ত গোলাপ;

আবিল গন্ধে তোমার রেশ খুঁজে পৌঁছে যাই স্বর্গের শেষমাথা;

ভষ্ম পোষাক— 

শান্তনার কাঁথা জড়িয়ে ঘামে ভেজা মাংসপিণ্ডে অধিকার লুপ্ত হয়।

দেখবার চোখ খুঁচিয়ে তোলা হয়— 

তবু কটমট করে চেয়ে থাকে রক্তাক্ত চৌগাঁথা।


এপিটাফ মুছে গ্যালে— 

এঁদো কাদায় আমার মতন পুতুল জন্মায়;

আমি তাকে আশীর্বাদের কালিতে নাম রেখে

ঈশ্বরের দোরগোড়ে রেখে আসি।

খোলস ভেঙে পৃথিবীর রঙে হলদে চোখ— 

মদের বোতলে রক্ত নেশা যৌবনের পানশালে।

পানফুলের আড়ালে ঈশ্বরের কারিশমা দ্যাখতে বসে আছে আমার শব— 

পানশালে বসে আছে আরেকটা আমি।

ঈশ্বর সাড়া দেন না, শাস্তি দেননা!

মৃত্যুদণ্ডের নসীব হয়না— 

য্যানো নিদারুণ বেঁচে থাকা চইরহীন ডিঙায়!


পরদাদা


শুনেছি আমার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন!

তাঁর বাবা, তাঁর বাবা, তাঁরও বাবা—

এমন করে যেতে যেতে অর্ধ-পৃথিবী অব্দি আমাদের ছিল। 

জেনেছি, আমার পরদাদার ধানের জমিতে তার বাবা সোনা ফলাতেন।

দাদিমা পান-বাটায় দোয়াত কালি লুকিয়ে লিখে গেছেন বিজয়গাঁথার মহাকাব্য,

উপদেশের ঝকঝকে তসবীহ

ধনভাণ্ডারের লোভনীয় পুঁথি

সাম্রাজ্যের গর্বিত উদ্যান!

আমরা প্রজন্মের 'পর প্রজন্মকে কঙ্কর বানিয়ে সুরম্য ইমারতের ঝাঁঝে তামাটে হই— 

খাতাভর্তি কবিতার কোথাও পূর্বপুরুষের সম্মানীর শামিয়ানা নেই—

অবশ্য অত্যাধুনিক পেয়ালায় ভর্তি শোকেস আছে মাইক্রোওভেন আছে

নাইফ-স্পুন আছে

শুধু শুভ্র ভাত নেই!

আমরা তাসমিয়া পড়ে ইট বালি সিমেন্ট মুখে পুরি—

থুথু আসে। তীব্র স্বাদে না-কি অনাদি ঘেন্নায় কে জানে!


বিলাপ 


 উপত্যকায় প্রবাহিত হচ্ছে নীলের সায়র;

দ্যাখো দ্যাখো, রেইন্ট্রি খুঁটি হোলো—

আলতো পরশে আঁটকে রেখেছে অর্ধপতিত চাঁদ, 

জ্যোৎস্নারা গলে পড়ছে, 

চেটে নিচ্ছে মৃত্তিকা!


আমি ওপারের বাসিন্দা, জলের জন্মচক্র দেখি—

খালি চোখে মাছ পাখির হাটবাজার দেখি। 

ঘর ভোলা দুটি পাতিহাঁস

সাঁতরানো রুপোলি রাজকন্যার প্রেমে গান গাইছে। 

আমার হৃদপিণ্ড এর বেশি অনুভব কোরে না। 


ফুল ফোটবার বাতাস বইছে, 

নৈঃশব্দের তীব্র আওয়াজ মহাকালের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো;

ঘাসফুলের খোয়াবে ভীতি এলো—

রঙ বদলালো চাঁদমুখের;

গোলাপি ঠোঁটের আরশিতে মুখ ভাসে মার্বেল শহরের। 


সমস্ত ব্যাবিলন নিজেই ঝুঁলন্ত কবিতার খাতায় বন্দী, 

নৌকার পাটাতনে উন্মাদ রাত্তির—

অলকানন্দার গন্ধ শুঁকে শরাব পচে যায়।

তবুও প্রেমিক চোখে আমার ভাসান ভিড়েনা—

দেখা হয়না মিশরীয় প্রেমিকের চোখের উত্তাল সমুদ্র! 

সন্ন্যাসী বুকেও খুনে-রক্তে ভিড় করছে—

       লক্ষাধিক কেটে ফেলা পা ঝুঁলে আছে শজারুর সরু-মাংশল ডালে:

        রক্তাক্ত জুতোরা আইনের গলে;

সাহসী বায়ুর ছোঁয়ায় মাথাচাড়া দেয় দ্রোহের ঘরচালা! 

ঝড়েরা গৃহ শত্তুর হয়; 

উড়িয়ে গুঁড়িয়ে

রাষ্ট্রের মতন ধ্বজভঙ্গ হয় চরিত্র!

বটবৃক্ষের আড়ালে নিরাপদ রয় বিষাদীয় উনুন।

        জ্বলে উঠে ঘেন্না-কাম

        ভুলে যায় খোদা-রাম

শ্মশানের লাকড়িতে বাগান হয় মরে যাওয়া প্রেম—

মিছিলেরা কাফন পরে হাঁটে

শ্লোগানেরা কাকন পরে নাচে

প্লেকার্ডেরা আরও রক্ত চোষতে দ্যাখে 

আমাদের সুরেরা বিলাপী হয় বৃষ্টি ফোঁটার মতন ঝিরিঝিরি—


বিচারের সুতোরা সিলিয়ে দেয় সমস্ত উচ্চারিত বোধ— কথিত উন্নয়নে নিভিয়ে দেয় রক্ত চোখের উষ্ণ-উষ্ণ ক্রোধ!


শেষ বিশ্বযুদ্ধের আগে


আমরা আর সবার মত না!

আমাদের বৈকালিক অভিসারে শকুনেরা ক্রন্দনে ক্রন্দনে পিয়ানোর সুর তোলে!

আমাদের প্রেমে গোলাপের বদলে হাতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যবহৃত 'এ৭ভি'

আমরা হাড়ের পর হাড়

খুলির পর খুলি

কঙ্কালের পর কঙ্কাল

প্রথম প্রেমিকের লাশ 

ধর্ষিতা কায়েদীর লাশ

শ্রেষ্ঠ মিনিস্টারের লাশ

পায়ে মারিয়ে সম্মুখে যাই পরস্পরের।

আমরা আর সবার মত না!

আমরা ইতিহাসের পর ইতিহাস কাটা চামচে কাটতে কাটতে—

খোঁচাতে খোঁচাতে,  হাসিমুখে কথা বলি।

আমরা বধ্যভূমির একেকটি এপিটাফে পা দোলাতে দোলাতে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি—

ডেকোরেশনের জন্য কেটে নেই সুদৃশ্য নাক, কান, বাদামী ধূসর চোখ!

আমরা জীবিত মানুষের গায়ে থুথু ফেলতে ফেলতে সকালে বৃষ্টি ভেজে মরে যাওয়া টুনটুনির পাখির জন্য শোক করি!

আহার শেষে সুরার গেলাশে রক্ত পান করতে করতে

পূর্বদিনের স্বাদের ফিরিস্তি দেই।

আমরা কুকুরজন্মের ঘেন্না কুড়াতে কুড়াতে পৃথিবীর সমস্ত ক্ষতস্থান ঢেকে ফেলি—

মনিবের থেকে পালাতে পালাতে আটলান্টিকের শেষ বরফখণ্ডে পিঠ ঠেকে যায়- স্থির হই;

আমরা আর সবার মত না;  আমরা প্রতারিত মানুষের চোখে মুখে করুণা ছুড়ে মারি

বলি প্রতারণা না বুঝলে ছাই খেতে পারতে ছাই

কেন বৃথাই মানুষ হয়ে মরতে গেলে ভাই!






লেখক পরিচিতি : 

TaniTamanna- তানি তামান্না

তানি তামান্না―

পড়াশোনা করছেন― ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে―



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ